২৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
কেবল রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর না করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য রপ্তানির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শুধু রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীলতা নয়, রপ্তানিনির্ভর বিদেশি মুদ্রা অর্জনের দিকে আমাদের আরও বেশি মনযোগ দিতে হবে।’
বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) সকালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেন্টেনিয়াল কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’সহ দেশের বিভিন্ন উপজেলায় নির্মিত ২৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের পণ্য যাতে বিদেশে রপ্তানি হয়, সেজন্য পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন রপ্তানিবাজার খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে যে পণ্যের চাহিদা, সে ধরনের পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন ও রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পদক্ষেপ আমরা নেব। আমাদের একটা কথা সব সময় মাথায় রাখতে হবে, পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে এবং নিজেদের পায়ে যেন দাঁড়াতে পারি, সে ব্যবস্থা করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিষয়ে নানা রকম মন্তব্য ও গুজবের বিষয়েও কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটু কম-বেশি হবেই। কিন্তু, আমাদের নানা লোকজন রয়েছে, যারা এটা নিয়ে নানারকম মন্তব্য এবং গুজব ছড়িয়ে বেড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের তিন মাসের খাদ্য কেনার যে রিজার্ভ, সেটা থাকলেই যথেষ্ট। তবে, ভোগ্যপণ্য এবং খাদ্যপণ্যে পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে, নিজের দেশে উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের যে উর্বর জমি ও জনসংখ্যা আছে, তাতে উদ্যোগ নিলে আমরা সেটা করতে পারি। শুধু উৎপাদন নয়, খাদ্যপণ্য সংরক্ষণ আধুনিকীকরণ করতে হবে এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও ব্যাপকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এতে দেশের মানুষের জন্য যেমন একটা বাজার তৈরি হবে, আবার বিদেশেও আমরা রপ্তানি করতে পারব।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাদের। তারই সাথে শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ অর্থহীন। কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই যুদ্ধে শুধু যারা অস্ত্র তৈরি করে তারাই লাভবান হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই যুদ্ধ, শুধু যুদ্ধই না, তার সাথে আবার স্যাংশন। এই স্যাংশন, পাল্টাপাল্টি স্যাংশনের ফলে আজকে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উন্নত দেশগুলো হিমসিম খাচ্ছে এবং তারা এখন বিদ্যুৎ সাশ্রয়, জ্বালানি সাশ্রয়, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত এবং সে কারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সেখানে আমাদের মতো দেশ, কেবল আমরা উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছি। আমরা একটা লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আপ্রাণভাবে। তখনই এই ধরনের বাধা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’
আমাদেরকে থেমে থাকলে চলবে না, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যাপারে সকল দেশই কিন্তু নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমরাও সেটা অনুসরণ করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দরকার হচ্ছে, একটা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। কেননা, আমাদের যুবসমাজ রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে এবং আমরা তা নিচ্ছি।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন। প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন এবং বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে নবনির্মিত টিটিসিগুলোর ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে চলমান দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে গৃহীত ‘৪০টি উপজেলায় ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামে ১টি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্প ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর একনেকে অনুমোদন হয়। বর্তমানে প্রকল্পটি ১ হাজার ৬৬৭ কোটি ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন আছে। এ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ৪০টির মধ্যে ইতোমধ্যে নির্মিত ২৪টি উপজেলায় ২৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আজ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। অবশিষ্ট ১৬টির নির্মাণ কাজও শিগগিরই সম্পন্ন হবে।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেন্টেনিয়াল টিটিসি। বাকি ২৩টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হচ্ছে রংপুরে পীরগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া, পাবনার সুজানগর, নরসিংদীর মনোহরদী, সিরাজগঞ্জ সদর ও কামারখন্দ, মুন্সিগঞ্জ সদর, দিনাজপুরের খানসামা, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা ও নগরকান্দা, খুলনার দিঘলিয়া, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, যশোরের কেশবপুর, চট্টগ্রামের রাউজান ও সন্দ্বীপ, কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও চৌদ্দগ্রাম, গাজীপুরের কাপাসিয়া, শেরপুর সদর, টাঙ্গাইলের কালিহাতী ও নাগরপুর, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা এবং কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায়।
বিদেশে দক্ষ কর্মী প্রেরণে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আরও স্কিল সংযোজনের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যানবাহন চালক হিসেবে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে ভারী যানবাহন চালনার বিষয়টিও যুক্ত করতে হবে। এতে আরও ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে বলেও আমি মনে করি।’
তিনি গৃহকর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে বিদেশ গমনেচ্ছুরা যেন সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা নিশ্চিত করার জন্যও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশে কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে সকল মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাসপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রমবাজার খুঁজবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় সার্টিফিকেট দেবে আর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মানুষ পাঠাবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে যৌথ ও মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। এসব কাজের জন্য প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিয়ে একটি কমিটি করে স্বউদ্যোগে কাজ করারও পরামর্শ দেন তিনি। তাহলে সব কাজ এক জায়গায় বসে সহজেই করা সম্ভব হবে। তিনি এর সঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়কেও সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
সরকার প্রধান এ সময় দালালের খপ্পরে পড়ে সোনার হরিণ ধরতে ভিটে-মাটি বিক্রি করে কেউ যেন আর প্রবাসের পথে পাড়ি না জমান সে জন্য যুবসমাজকে সতর্ক করেন। কারণ, এভাবে গেলে তারা বিপদে পড়ে এবং সরকারের পক্ষ থেকেই তাদের উদ্ধার করতে হয় অথবা ভূমধ্যসাগরে তাদের সলিল সমাধি হয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রয়োজনে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি বিদেশে যাবার আহবান জানিয়ে বলেন, এখানে বিনা জামানতেও ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা রয়েছে।
সরকার যে টিটিসি করে দিচ্ছে এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি সম্ভব হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। বিদেশ গমনেচ্ছুরা যেন যথাযথ প্রশিক্ষণ নেন, তা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেন তিনি।
তথ্যসূত্র: বাসস